somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে-১৬

০৩ রা নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গাড়ি এগিয়ে চললো। পিছে ফেলে চললাম আমার এইটুকু বয়সের সকল অতীত, আনন্দ বেদনা ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং সকল অভিমান। এতক্ষন কান্না পায়নি আমার কিন্তু ঠিক এই সময়টাতেই আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। ডুকরে উঠলাম আমি। ঠিক তখনই অনুভব করলাম আমার ডান হাতটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে আছে কেউ একজন। সে আর কেউ নয়, সেই আমার স্বামী। আমার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের নতুন নায়ক।

পেছনের সিটে আরও একজন ছিলো আমার ছোট ননদ আর গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো আমার এক খালাত দেবর। তখনও তাদের কাউকেই আমি চিনিনা। চেনার চেষ্টাও করছিলাম না। সামনের সিটে বসেছিলেন বড় দুলাভাই। নানারকম হাস্যরসে মেতে উঠেছিলো তারা। কিন্তু সেসব কিছুই আমার কানে ঢুকছিলো না। আমি আমার এই কিছু্ক্ষন আগে ছেড়ে আসা জীবন, সামনের পথ, এক গাদা নতুন সব মানুষ ঘিরে থাকা সব কিছু মিলিয়ে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম বার বার।

সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে আমার আসল শ্বশুরবাড়িতে আনা হলো না। বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হলো সেই ডিসি সাহেবের বাংলোয়। ডিসি সাহেবের মোটাসোটা বৌটা নিজেই হাত ধরে নামালেন আমাকে গাড়ি থেকে। হাসিখুশি মহিলাটা নিজের আনন্দে নিজেই উদ্ভাষিত ছিলেন।
- এই আসো আসো বউকে নামাতে হবে। এ্যাই মেজু। তোমার ছেলের বউ। বউকে ধরো ধরো। এই নীপা ভাবীকে ধর সবাই..... ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি কলকাকলীতে উচ্ছল তরুনীর মত মেতে উঠলেন তিনি। ডিসি সাহেবের বাংলোটা আমাদের বাড়ির মত অত বড় চৌহদ্দী না হলেও সেটাও বেশ সুবিশালই ছিলো। কিন্তু ঐ অত টুকুন সময়ে আমার যেটা পার্থক্য লাগলো আমাদের বাগানের ফলফুলের গাছগুলি নিজের আনন্দে বেড়ে ওঠা এবং একটু এলোমেলো আর এই বাগানের গাছগুলি সুপরিকল্পিত যতনে কেটে ছেটে আটোসাটো বাঁধনে যেন বাড়িয়ে তোলা। লম্বা লাল সুর্কীর রাস্তার উপরে গাড়ি থেমেছিলো সেখান থেকে নামিয়ে আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে সিড়িতে উঠানো হলো। দুপাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছড়াচ্ছিলো। আমাদের বাড়ি থেকে ১০মিনিটের রাস্তা। তখনও সন্ধ্যা পেরোয়নি। রাত নেমে আসেনি। সেই ঘোর ঘোর সন্ধ্যায় এক আশ্চর্য্য ঘোরের মাঝ দিয়েই সেই লাল সুরকির রাস্তার দুপাশে ঝাউগাছের সারির পেরিয়ে হেটে গিয়ে লাল রঙ্গের পুরান আমলের ব্রিটিশ স্ট্রাকচারের এক গৃহে গৃহপ্রবেশ হলো আমার।

গৃহ প্রবেশের ঠিক আগে, গৃহদ্বারে আবার আরেক অনুষ্ঠানের সূচনা হলো। মিষ্টি খাওয়া, শরবৎ খাওয়া। আমার বমি পাচ্ছিলো। এখনকার দিনে বউরা বলে দেয় এত মিষ্টি খেতে পারবে না কিন্তু সে সময় কণেদের বমি পেলেও মিষ্টি খেতেই হত এবং মিষ্টি খেয়েও বমি করা চলবে না এই ছিলো এক অগ্নিপরীক্ষা। এরপর আরও এক অগ্নি নহে আস্ত আগ্নেয়গিরি পরীক্ষাই দিতে হলো আমাকে। মিষ্টি শরবৎ ইত্যাদি খাওয়া শেষে ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন রোল তুললো, জামাই কোলে নাও বউকে। কোলে নিয়ে ঘরে নিয়ে চলো। আমার তো সে কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো। কোলে নেবে! কি সর্বনাশ! ভাবনার মাঝেই আমি উপলদ্ধি করলাম আমি শূন্যে। আমার নতুন জামাই আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে চলেছে আর সবাই হাত তালি দিচ্ছিলো। আমি আড়স্ঠ হয়ে রইলাম। কিন্তু নতুন জামাই এর যেন কোনোই ভাবান্তর ছিলো না। সে ছিলো সাবলীল ও সাচ্ছন্দ্য। সে কোলে করে এনে এসে নামালো এক সুসজ্জিত ড্রইং রুমে।

ডিসি সাহেবের বিদেশী কেতায় সুসজ্জিত এলাহী সেই ড্রইং রুমে একজন সাদা শাড়ি পরা বৃদ্ধা মহিলা হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন। ডিসি সাহেবের শশব্যস্ত বউ মানে আমার মামীশ্বাশুড়ি উনার সামনে আমাকে নিয়ে গিয়ে বললেন ইনি নানীশ্বাশুড়ি হন তোমার সালাম করো। আমি পা ছুঁয়ে সালাম করতেই উনি আমাকে হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসালেন। তারপর আমার হাতখানা টেনে নিয়েবহাতে দিলেন এক আশ্চর্য্য জিনিস। মালা নয় বালা নয় এমনকি আংটি দুল কিছুই নয় গোলাকার একটি সোনার চাকতি। বললেন,
- এই আকবরী মোহরখানা আমার বাবা দিয়েছিলেন আমাকে। আমি তোমাকে দিলাম। যত্ন করে রেখো।
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। সেই মোহরখানা হাতে নিয়ে ঐ অমন অচেনা অজানা সন্ধ্যাতেও আমার মনে পড়ে গেলো ছেলেবেলার প্রিয় হাসির গল্প গোপাল ভাঁড়ের কথা। ( কেনো মনে পড়লো চুয়াত্তরভাইয়ার জন্য এটা ধাঁধা রেখে দিলাম)

যদিও সেটি আমার নিজের শ্বশুরবাড়ি ছিলো না। কিন্তু সেই রাতে ঐ বাড়িতেই বাসর ঘর সাজানো হলো। আমাকে এনে বসানো হলো সেই ঘরের ফুল ছড়ানো বিছানার উপর। ঠিক সিনেমার মত করেই স্ট্যান্ডবেডের চারধার থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ফুলের মালার লহর। আজকাল কত রকম রঙ্গে ও ঢঙ্গে বিয়ের বেড সাজানো হয় তখন সেসব তেমন ছিলো না বললেই চলে। ডিসি সাহেবের পাইক আর্দালীরাই মনে হয় সেসব সাজিয়েছিলো। তবুও সিনেমার মত সাজানো সেই সুন্দর বাসর সজ্জাখানা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম।

সাারাদিনের ক্লান্তি আর সারারাত্রী জাগরণে আমার সারা শরীর ভেঙ্গে আসছিলো। তবুও কোথাও এক রত্তি শান্তি ছিলো না। চারপাশে এক গাদা মানুষ। ভাবী, খালা, চাচী, মামী, ফুপু ননদ নানা বয়সী মেয়েদের কলহাস্য রসিকতায় মুখরিত সেই পরিবেশে মুক ও বধির আমার তখন ভাঙ্গচুর দশা। আমি একটু শান্তিতে ঘুমানোর পথ খুঁজছিলাম। সারাজীবন উপন্যাস বা সিনেমায় দেখেছি বাসরঘরের শুনশান পরিবেশ আর সেখানে নায়ক নায়িকা ছাড়া কেউ থাকেনা। নায়িকা হাঁটুতে মুখ রেখে নায়কের জন্য অপেক্ষা করে তারপর নায়ক আসে। আর এ কোন বাসর ঘরে এলাম যেখানে থই থই মানুষ। একটু শান্তিতে মুখ ফেরানোরও উপায় রইলো না?


কিছুক্ষনের মধ্যেই মুখ তুলে চাইলেন খোদা। ডিসি সাহেবের সদাব্যস্ত বউটা কই থেকে হই হই করে এসে ঘর থেকে সকল জনতা হটিয়ে দিলেন। তারপর আমার কাছে এসে বললেন, সবে সন্ধ্যা। কিছুক্ষন পরেই রাতের খাবার দেওয়া হবে। আমার বড় মেয়ে আসছে তোমার স্যুটকেস থেকে কাপড় বের করে পরিয়ে দেবে। শুধু এই ভারী কাতানটা বদলে একটা আরামদায়ক শাড়ী পরিয়ে দিক। গয়না খোলার দরকার নেই। খোঁপাটাও বাঁধা থাকুক। তোমার বর এসে দেখুক।

ডিসি সাহেবের বউ এর এত ক্ষনের কথা শুনে আমার মনে যে শান্তির উদয় হয়েছিলো আবার তার এই কথা শুনে সেই শান্তি উবে গেলো।আমার মাথায় বাঁজ ভেঙ্গে পড়লো। বলে কি! এমনিতেই খোঁপার উপর এক গাঁদা স্প্রে করে দেওয়ায় আমার মাথা কুট কুট করছিলো। কখন চুল খুলে শান্তি করে আঁচড়াবো তানা উনি বলেন খোঁপা বাঁধা থাকুক! আমার তখন ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। তবুও মুখে তালা দিয়ে বসে রইলাম। কারণ সেটাই ছিলো নিয়ম। নতুন বউদের হই হই করে কথা বলতে নেই তাতে লোক বেহায়া বলে।

কিছুপরে সেখানে এলো এক অপূর্ব সুন্দর কলাপাতা রং শাড়ি পরা এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হল হঠাৎ যেন এক সবুজ পরী পাখা ছেড়ে এসে নামলো আমাদের এই ঘরে। তাকে দেখে আমার মামীশ্বাশুড়ী ডিসি সাহেবের বউটা বলে উঠলো,
- এই যে আমার মেয়ে। এই যে নে নে ভাবীকে সাহায্য কর শিঘ্রী..... ওর স্যুটকেস থেকে একটা সূতী শাড়ি বের করে ওরে পরায় দে।

সেই পরীর মত মেয়েটা আমার স্যুটকেস খুলে শাড়ী পছন্দ করতে লাগলো। ডিসি সাহেবের বউ তলার দিক থেকে টেনে বের করলো একটা জরীপাড় লাল সূতী শাড়ি । বললেন এটা ঠিক আছে এটা পরায় দে।
ডিসি সাহেবের বউ বের হয়ে যেতেই মেয়েটা শাড়ি হাতে আমার কাছে এসে বসলো। বললো,
- কি ভাবী। কেমনে মজা? তার চোখে কৌতুক ছিলো। এমনিতেই এত সুন্দর একটা মেয়েকে দেখে আমি প্রায় বাক্যহরা আর তার উপরে কি বলছে এ? আমি অবাক হয়ে বললাম,
- কিসের মজা?
মেয়েটা হাসতে হাসতে মরে গেলো। বললো,
- আমি ভেবেই পাইনা মানুষ এত ঝামেলা করে বিয়ে করে কেনো? তোমাকে দেখে আমার ভীষন মায়া হচ্ছে। চলো শাড়ি চেঞ্জ করে তোমার গহনা খোঁপা সব খুলে দিচ্ছি। তুমি আরাম করে বসো। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
- সবাই বকে যদি? তোমার মা?
- মানে? বকবে কেনো?
- উনি বললেন না খোঁপা খোলার দরকার নেই?
সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। বললো,
- বকলে বলবা তোমার বাদশাহ অর্ডার দিয়েছে। জবরজং হয়ে বসে থাকতে হবে না। চলো চলো হাত মুখ ধুয়ে শান্তি করে বসো।

আমি হাফ ছেড়ে বাঁচালম। মেয়েটা মনে হয় সত্যিই পরী ছিলো। শুধু পরী না ভালো পরী। আমাকে অমন বিপদ থেকে রক্ষা করলো।


আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪৪
৫১টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×